আমার কবিতা তুমি

প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,

আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!

জুড়াল গো তার শত জনমের রৌদ্রদগ্ধ-কায়া–

এতদিনে পেল তার স্বপনের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া!

চেয়ে দেখো প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে

গোলাপ দ্রাক্ষাকুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে!


গভীর নিশীথে, হে মোর মানসী, আমার কল্পলোকে

কবিতার রূপে চুপে চুপে তুমি বিরহ-করুণ চোখে

চাহিয়া থাকিতে মোর মুখ পানে ; আসিয়া হিয়ার মাঝে

বলিতে যেন গো – ‘হে মোর বিরহী, কোথায় বেদনা বাজে?’

আমি ভাবিতাম, আকাশের চাঁদ বুকে বুঝি এল নেমে

মোর বেদনায় বুকে বুক রাখি কাঁদিতে গভীর প্রেমে!

তব চাঁদ-মুখপানে চেয়ে আজ চমকিয়া উঠি আমি,

আমি চিনিয়াছি, সে চাঁদ এসেছে প্রিয়া-রূপ ধরে নামি!


যত রস-ধারা নেমেছে আমার কবিতার সুরে গানে

তাহার উৎস কোথায়, হে প্রিয়া, তব শ্রীঅঙ্গ জানে।

তাই আজ তব যে অঙ্গে যবে আমার নয়ন পড়ে,

থির হয়ে যায় দৃষ্টি সেথাই, আঁখি-পাতা নাহি নড়ে!

তোমার তনুর অণু-পরমাণু চির-চেনা মোর, রানি!

তুমি চেন নাকো ওরা চেনে বলে, ‘বন্ধু তোমারে জানি।’

অনন্ত শ্রীকান্তি লাবণি রূপ পড়ে ঝরে ঝরে

তোমার অঙ্গ বাহি, প্রিয়তমা, বিশ্ব ভুবন-পরে!

মন্ত্র-মুগ্ধ সাপের মতন তোমার অঙ্গ পানে

তাই চেয়ে থাকি অপলক-আঁখি, লজ্জারে নাহি মানে!


তুমি যবে চল, যবে কথা বল, মুখ পানে চাও হেসে

মূর্তি ধরিয়া ওঠে যেন সেথা আমার ছন্দ ভেসে।

মনে মনে বলি, তুমি যে আমার ছন্দ-সরস্বতী,

ওগো চঞ্চলা, আমার জীবনে তুমি দুরন্ত গতি!

আমার রুদ্র নৃত্যে জেগেছে কঙ্কালে নব প্রাণ,

ছন্দিতা ওগো, আমি জানি, তাহা তব অঙ্গের দান!

নাচ যবে তুমি আমার বক্ষে, রুধির নাচিয়া ওঠে

সেই নাচ মোর কবিতায় গানে ছন্দ হইয়া ফোটে।

মনে পড়ে যবে তোমার ডাগর সজল-কাজল আঁখি,

সে চোখের চাওয়া আমার গানের সুর দিয়ে বেঁধে রাখি।

প্রেম-ঢলঢল তোমার বিরহ-ছলছল মুখ হেরি

ভাবের ইন্দ্রধনু ওঠে মোর সপ্ত আকাশ ঘেরি।

আমার লেখার রেখায় রেখায় ইন্দ্রধনুর মায়া,

উহারা জানে না, এই রং তব তনুর প্রতিচ্ছায়া!

আমার লেখায় কী যেন গভীর রহস্য খোঁজে সবে

ভাবে, এ কবির প্রিয়তমা বুঝি আকাশ-কুসুম হবে!

উহারা জানে না, তুমি অসহায় কাঁদ পৃথিবীর পথে,

উহারা জানে না রহস্যময়ী তুমি মোর লেখা হতে।


আমিই ধরিতে পারি না তোমারে, উহারা ধরিতে চায়,

সাগরের স্মৃতি খুঁজে ওরা মরুভূর বালুকায়!

তোমার অধরে আঁখি পড়ে যবে, অধীর তৃষ্ণা জাগে,

মোর কবিতায় রস হয়ে সেই তৃষ্ণার রং লাগে।

জাগে মদালস-অনুরাগ-ঘন নব যৌবন-নেশা

এই পৃথিবীরে মনে হয় যেন শিরাজি আঙুর-পেশা!

সুর হয়ে ওঠে সুরা যেন, আমি মদিরা-মত্ত হয়ে

যৌবন-বেগে তরুণেরে ডাকি খর তরবারি লয়ে।

জরাগ্রস্ত জাতিরে শুনাই নব জীবনের গান,

সেই যৌবন-উন্মদ বেগ, হে প্রিয়া তোমার দান।

হে চির-কিশোরী, চির-যৌবনা! তোমার রূপের ধ্যানে

জাগে সুন্দর রূপের তৃষ্ণা নিত্য আমার প্রাণে।

আপনার রূপে আপনি মুগ্ধা দেখিতে পাও না তুমি

কত ফুল ফুটে ওঠে গো তোমার চরণ-মাধুরী চুমি!

কুড়ায়ে সে ফুল গাঁথি আমি মালা কাব্যে-ছন্দে-গানে,

মালা দেখে সবে, জানে না মালার ফুল ফোটে কোনখানে!


হে প্রিয়া, তোমার চির-সুন্দর রূপ বারে বারে মোরে

অসুন্দরের পথ হতে টানি আনিয়াছে হাত ধরে।

ভিড় করে যবে ঘিরিত আমারে অসুন্দরের দল,

সহসা ঊর্ধ্বে ফুটিয়া উঠিত তব মুখ-শতদল।

মনে হত, যেন তুমি অনন্ত শ্বেত শতদল-মাঝে,

মোর প্রতীক্ষা করিতেছ প্রিয়া চির-বিরহিণী সাজে।

সেই মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি পৃথিবীর দেশে দেশে,

শ্রান্ত স্বপনে হৃদয়ে-গগনে ও মুখ উঠিত ভেসে!

যেই ধরিয়াছি মনে হত হায়, অমনই ভাঙিত ঘুম,

স্মৃতি রেখে যেত আমার আকাশে তব রূপ-কুঙ্কুম!

দেখি নাই, তবু কহিতাম গানে ‘সাড়া দাও, সাড়া দাও,

যারা আসে পথে, তারা তুমি নহ, ওদের সরায়ে নাও!’

ভেবেছিনু, বুঝি পৃথিবীতে আর তব দেখা মিলিল না,

তুমি থাক বুঝি সুদূর গগনে হয়ে কবি-কল্পনা।

সহসা একদা প্রভাতে যখন পাখিরা ছেড়েছে নীড়,

হারানো প্রিয়ারে খুঁজেছি আকাশে অরুণ-চন্দ্রাপীড়,

আমি পৃথিবীতে খুঁজিতেছিনু গো আমার প্রিয়ারে গানে,

থমকি দাঁড়ানু, চমকি উঠিনু কাহার বীণার তানে!

বেণু আর বীণা এক সাথে বাজে কাহার কন্ঠ-তটে,

কার ছবি যেন কাঁদিয়া উঠিল লুকানো হৃদয়-পটে।

হেরিনু আকাশে তরুণ সূর্য থির হয়ে যেন আছে,

কে যেন কী কথা কয়ে গেল হেসে আমার কানের কাছে।

আমার বুকের জমাট তুষার-সাগর সহসা গলে

আছাড়িয়া যেন পড়িতে চাহিল তোমার চরণ-তলে।

ওগো মেঘ-মায়া, বুঝিয়াছিলে কি তুমি?

দারুণ তৃষায় তব পানে ছিল চেয়ে কোনো মরুভূমি?

তুমি চলে গেলে ছায়ার মতন, আমি ভাবিলাম মায়া,

কল্প-লোকের প্রিয়া আসে না গো ধরণিতে ধরি কায়া!


ভেবেছিনু, আর জীবনে হবে না দেখা –

সহসা শ্রাবণ-মেঘ এল যেন হইয়া ব্রজের কেকা!

যমুনার তীরে বাজিয়া উঠিল আবার বিরহী বেণু,

আঁধার কদম-কুঞ্জে হেরিনু রাধার চরণ-রেণু।

যোগ-সমাধিতে মগ্ন আছিনু, ভগ্ন হইল ধ্যান,

আমার শূন্য আকাশে আসিল স্বর্ণ-জ্যোতির বান।

চির-চেনা তব মুখখানি সেই জ্যোতিতে উঠিল ভাসি

ইঙ্গিতে যেন কহিলে, ‘বিরহী প্রিয়তম, ভালোবাসি!’

আমি ডাকিলাম, ‘এসো এসো তবে কাছে।’

কাঁদিয়া কহিলে, ‘হেরো গ্রহ তারা এখনও জাগিয়া আছে,

উহারা নিভুক, ঘুমাক পৃথিবী, ঘুমাক রবি ও শশী,

সেদিন আমারে পাবে গো, লাজের গুন্ঠন যাবে খসি।

কেবল দুজন করিব কূজন, রহিবে না কোনো ভয়,

মোদের ভুবনে রহিবে কেবল প্রেম আর প্রেমময়।’


‘আমি কী করিব?’ কহিলাম আঁখি-নীরে

কহিলে ‘কাঁদিবে মোর নাম লয়ে বিরহ-যমুনাতীরে!

যমুনা শুকায়ে গিয়াছে প্রেমের গোকুলে এ ধরাতলে,

আবার সৃজন করো সে যমুনা তোমার অশ্রুজলে।

তোমার আমার কাঁদন গলিয়া হইবে যমুনা জল

সেই যমুনায় সিনান করিতে আসিবে গোপিনীদল,

ওরা প্রেম পাবে, পাইবে শান্তি, পাবে তৃষ্ণার মধু,

তোমারে দিলাম চির-উপবাস, পরম বিরহ, বঁধু!’

‘এ কী অভিশাপ দিলে তুমি’ বলে যেমনই উঠি গো কাঁদি,

হেরি কাঁদিতেছ পাগলিনি মোর হাত দুটি বুকে বাঁধি!

আজ মোর গানে কবিতায়, সুরে তুমি ছাড়া নাই কেউ,

সেই অভিশাপ যমুনায় বুঝি তুলেছে বিপুল ঢেউ!

সবার তৃষ্ণা মিটাইতে আমি যমুনা হইয়া ঝরি,

জানে না পৃথিবী, কোন নিদারুণ তৃষ্ণা লইয়া মরি!

বড়ো জ্বালা বুকে, বলো বলো প্রিয়া – না-ই পাইলাম কাছে,

এই বিরহের পারে তব প্রেম আছে আজও জেগে আছে!

যদি অভিমান জাগে মোর বুকে না বুঝে তোমার খেলা,

দূরে থাক বলে ভাবি যদি তারে অনাদর অবহেলা –

কেঁদে কেঁদে রাতে যদি মোর হাতে লেখনী যায় গো থামি,

বিরহ হইয়া বুকে এসে মোর কহিয়ো – ‘এই তো আমি।’